“আমি ছিলাম অন্যদের মতো নেহাৎ একজন মানুষ, আরাম কেদারায় ঘুমন্ত, যখন সর্ব-মহিমাময়ের বাতাস আমার ওপর দিয়ে বইয়ে গেলো, এবং বর্তমান থাকা সকল জ্ঞান শিখিয়ে দিলো। এটা আমার থেকে আসেনি, এসেছে একজনের থেকে যিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ...তাঁর সর্ববাধ্যকারী আহ্বানসমূহ আমার কাছে পৌঁছেছিলো, এবং আমাকে সকল জনগনের কাছে তাঁর প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ করার কারণ ঘটিয়েছিলো।”
— বাহাউল্লাহ
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ ছিলো মানবজাতির জীবন জাগরণের নতুন সময়। সারা ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, চীন, ভারত এবং উত্তর আমেরিকাব্যাপী, একের পর এক, জনগণ অত্যাচারী রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাগুলিকে উৎখাত করতে জেগে উঠেছিলো। মনে হয়েছিলো যেন মানব সচেতনতা দীর্ঘ রাত্রির নির্বিকারত্ব এবং বশ্যতা থেকে জাগরিত হচ্ছে।
সর্বত্র মানবজাতির ন্যায়, সমতা এবং উৎকর্ষতার উপর ভিত্তি করে সমাজের একটি নতুন কল্পদৃশ্যের জন্য ব্যাকুলতা ছিলো। একটি বোধ এই কারণে যে, একটি হাতের কাছে থাকা মহান যুগের ঊষাকাল সেইসময়ে কবিদের ভাষায় ধরা পড়েছিলো। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “বর্তমান যুগে একটি নতুন যুগের এই ঊষাকালের জন্য নিজেদের এবং চারপাশের জন্য তৈরি করতে সকল ব্যক্তির কাছে আহ্বান এসেছে, যখন মানুষ তার আত্মাকে সকল মানবজাতির আধ্যাত্মিক একতায় আবিষ্কার করবে।”
এইরকম সময়ে, যা পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থানে অজ্ঞাত, ঈশ্বরের একটি নতুন বার্তার সুর্য ইরানে উদিত হয়েছিলো বাহাউল্লাহর আগমনের মাধ্যমে, যিনি ছিলেন মানবজাতির কাছে যুগের আগমনে ঈশ্বরের বার্তাবহ। বাহাউল্লাহ শিখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর একজনই, এবং সকল ধর্মগুলি একই ঈশ্বর থেকে এসেছে এবং মমার্থ হিসেবে সত্য এবং মানবজাতির একত্বের জন্য সময় এসেছে।
বাহাউল্লাহর জীবন একই সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলীতে বৈশিষ্ঠ্যমণ্ডিত হয়েছিলো যা অন্য মহান ধর্মগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের পার্থিব জীবনসমূহে প্রভেদ দেখিয়েছিলো। ১৮১৭ সালে ইরানের একটি অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর শিশু বয়সের শুরু থেকে বাহাউল্লাহ অসামান্য প্রজ্ঞার পরিচয় দেন এবং তাঁর দয়া, উদারতা এবং ন্যায়ের গুণাবলী ছিলো অনুপম। তাঁর বাবার মৃত্যু্র পর, তাঁকে রাজ দরবারে উচ্চপদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়, যা তিনি নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন, পরিবর্তে তিনি তাঁর সময় অত্যাচারীতদের, অসুস্থ এবং গরীবদের জন্য উৎসর্গ করতে পছন্দ করেছিলেন।
যখন বাহাউল্লাহ তাঁর মিশন ঘোষণা করেছিলেন ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একটি নতুন ধর্মের অবতার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে, তাঁর শিক্ষাগুলি আধুনিকত্বের উদঘাটনে বৈপ্লবিক। তাঁর কেন্দ্রিয় মূলনীতি—যে মানবজাতির একত্বের জন্য আগত সময়কে উপলব্ধি করা—যা একগুচ্ছ সামাজিক শিক্ষাবলী যেমন পুরুষ এবং নারীর সমতা, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সংগতি, সত্যের স্বাধীন অনুসন্ধানের প্রয়োজন, যাজক বৃত্তির লোপসাধন, সকল আকারের পূর্বসংস্কার বর্জন এবং সর্বজনীন শিক্ষা।
তাঁর শিক্ষাগুলি সেইসময়ের যাজক এবং রাজনৈতিক গোঁড়ামির কাছ থেকে বর্ধিতহারে বিরুদ্ধাচরণ সঞ্চার করেছিলো যা মধ্যযুগীয় মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলো। ইরানের শিয়া সম্প্রদায় এবং তার সঙ্গে সেই সময়ের দুটি অত্যন্ত শক্তিশালী পরিষদবর্গ—ইরানের রাজা এবং অটোমান সাম্রাজ্য—তাদের ক্ষমতায় তাঁর প্রভাব প্রশমনে সবরকম প্রচেষ্টা করেছিলো। বাহাউল্লাহকে তাঁর সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো, অত্যাচার এবং পেটানো হয়েছিলো, জেলে শিকল পরানো হয়েছিলো, ১৮৯২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের আক্রের বন্দী শিবিরে মৃত্যু পর্যন্ত (আজকের ইজরায়েলের আক্কা)।
ভয়াবহ দুর্দশাগুলি সত্ত্বেও, বাহাউল্লাহ তাঁর মিশন এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মানবজাতির পথনির্দেশিকার স্বার্থে একশর বেশী খণ্ডসমূহে পবিত্র রচনা প্রকাশ করেন। তাঁর ছিলো মহত্ত্বে অজেয় ধর্ম যাতে মানবজাতি উত্থিত হতে পারে এবং সেই রূপান্তরের বীজগুলি বপন করতে কোনও কষ্ট অথবা উৎসর্গ যাতে তাকে নিবৃত্ত করতে পারে যা মানবজাতি তার প্রকৃত নিয়তি অর্জন করতে পারে। তাঁর জীবনকালে, বাহাউল্লাহর প্রভাব তাঁর শত্রুদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বেড়ে উঠেছিলো। যেখানেই তিনি নির্বাসিত হয়েছিলেন, সহস্রাধিক তাঁর শিক্ষাগুলিতে এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ভালোবাসা, শক্তি এবং মহত্ত্বে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আজ তাঁর ধর্ম পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে গেছে এবং ষাট লক্ষেরও বেশী অনুগামীবৃন্দ এবং দশ লক্ষেরও বেশী অন্যান্যরা একটি একতাবদ্ধ পৃথিবী গড়তে তাঁর জীবন এবং বানীসমূহ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করছে।
ক্যা্মব্রিজ প্রাচ্যবিদ্যাবিদ এডওয়ার্ড গ্রানভিলে ব্রাউন বাহাউল্লাহর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি ভাবীকালের জন্য এই অনুভূতি জাগানো কলমচিত্র রেখে গেছেনঃ “তাঁর সেই মুখ যার প্রতি আমি দৃষ্টিপাত করেছিলাম, তা আমি কখনও ভুলবোনা, যদিও আমি তা বর্ণনা করতে অপারগ। সেই তীক্ষ্ণ চোখদুটি যেন একজনের প্রকৃত আত্মার অর্থ বুঝে নিতে পারে; শক্তি এবং কর্তৃত্বভরা সেই প্রশস্ত ললাট ...জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই, আমি তার উপস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি, যখন আমি একজনের সামনে মাথা নত করে আছি, যিনি একটি শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার লক্ষ্যবস্তু যা দেখে রাজাগণ হয়তো ঈর্ষা করবেন এবং সম্রাটগণ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবেন।”
Exploring this topic:
The Life of Bahá’u’lláh
The Early Bahá’í Community
The Shrine of Bahá’u’lláh
Quotations
Articles and Resources